ডায়াবেটিস সর্বগ্রাসী রোগ। এ রোগ একবার কারো হলে শরীরে নানা জটিলতা বাড়তে থাকে। মধ্যবয়সে সাধারণত ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। তবে বর্তমানে তরুণ বয়সেও অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। শিশুদেরও ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা এমন প্রশ্ন জনে জনে।

মূলত মানসিক দুশ্চিন্তা, ওজন বেড়ে যাওয়া, কায়িক শ্রমের ঘাটতি, বংশীয় কারণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবন পদ্ধতির পরিবর্তন এসব কারণে ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস ধরা পড়ার আগেই সতর্ক থাকতে হয়।

শিশুদের ডায়াবেটিস রোগের ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন।

শিশুদের মধ্যেও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। বেশিরভাগ শিশু শৈশবে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। আগে চিকিৎসকরা জানতেন যে বাচ্চারা কেবল টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয় এবং একে দীর্ঘকাল ধরে কিশোর ডায়াবেটিস (Juvenile Diabetes) নামে নামকরণ করা হতো।

শিশুদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একক প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত ওজন। যখন কোনো শিশুর ওজন খুব বেশি বেড়ে যায়, তখন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা দ্বিগুণ হয়।

শিশুদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস অবস্থায় শরীরে ইনসুলিন উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিনের দরকার পড়ে। ইনসুলিনের ঘাটতি বা অভাবকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন বা পাম্পের মাধ্যমে পূরণ করা হয়। অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কারণ ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো ধ্বংসের কারণে এমনটি হয়। কেন এমনটি ঘটে তা সঠিকভাবে কেউ জানেন না, তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটা জিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

টাইপ-১ ডায়াবেটিস সম্ভবত ভাইরাসের সংক্রমণের কারণেও হয়ে থাকে। অন্যদিকে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসে, অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন তৈরিতে কোনো ব্যাঘাত হয় না। তবে শরীর এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে সাড়া দেয় না বা প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স্ (Insulin Resistance)-এর কারণে এ সমস্যা দেখা দেয় যখন গ্লুকোজ কোষগুলোতে প্রবেশ করতে পারে না এবং শক্তি সরবরাহ করার সক্ষমতা কমে যায়।

এ কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে পর্যায়ক্রমে অগ্ন্যাশয় আরও বেশি বেশি ইনসুলিন তৈরি করতে সচেষ্ট হয়। অবশেষে, এক সময় অগ্ন্যাশয় রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পরে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য বাচ্চাদের ঝুঁকির তিনটি কারণ-

* পরিবারের একজন সদস্যের টাইপ ২ ডায়াবেটিস থাকলে।

* মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসসহ (গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস) জন্ম নেওয়া শিশুদের।

* যদি সন্তানের ওজন বেশি হয় এবং ওপরের দুটি ঝুঁকির কারণ থাকে।

ডায়াবেটিসের লক্ষণ : রক্তে উচ্চমাত্রার শর্করার জন্য ঘনঘন প্রস্রাব হয় এবং খুব তৃষ্ণার্ত থাকে বিধায় প্রচুর পানি পান করতে হয়। ক্লান্তি বা অবসাদ বোধ থাকে। কারণ শরীর শক্তির জন্য গ্লুকোজ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু এবং কিশোরদের ক্ষুধা বাড়তে পারে তবে ক্ষুধার্ত কোষগুলোকে জ্বালানি সরবরাহ করার প্রয়াসে শরীর পেশি ভেঙে ফ্যাট সংরক্ষণ করে যার জন্য ওজন হ্রাস পায়।

ডায়াবেটিসের চিকিৎসা : শিশুর টাইপ-১ বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস আছে কিনা তা নির্ণয় করা আবশ্যক। কারণ ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসা টাইপের ভিত্তিতে পৃথক হয়। মেটফরমিন নামে একটি ওষুধ গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। এটি এবং ইনসুলিন হলো ১৮ বছরের চেয়ে কম বয়সি শিশুদের জন্য রক্তে শর্করার হ্রাসকারী দুটি ওষুধ মাত্র।

চিকিৎসা অর্থাৎ লক্ষণগুলো হ্রাস করার জন্য ভালো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ এবং শিশু যাতে স্বাভাবিকভাবে তার শারীরিক, মানসিক, সংবেদনশীলতা বজায় রেখে সামাজিক বৃদ্ধি এবং বিকাশে সম্ভব হয়। আর এর জন্য, বাবা-মাকে লক্ষ রাখতে হবে শিশুর রক্তের শর্করার মাত্রা যতটা সম্ভব লক্ষ্য সীমার মধ্যে রাখা।

ডায়াবেটিসের কোনো নিরাময় নেই, ডায়াবেটিসের জন্য আজীবন চিকিৎসা প্রয়োজন। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু-কিশোররা তাদের রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিদিন ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্পের ওপর নির্ভর করে। শিশুদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে লক্ষণ ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং প্রথম দিকে কোনো লক্ষণই থাকে না। কখনো নিয়মিত চেক-আপের সময় এই ব্যাধিটি শনাক্ত করা হয়।

ডায়াবেটিস থেকে জটিলতা

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে ভবিষ্যতে হৃদরোগ, অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে এবং কিডনি অকার্যকর হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। এছাড়া ডায়াবেটিসে পরবর্তী জীবনে সরু রক্তনালি, উচ্চরক্তচাপ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। স্নায়ু বা নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রতিরোধ

তরুণদের মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সমস্যা বাড়ছে। বাবা-মায়ের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে এ ভয়াবহ অবস্থার প্রতিরোধ সম্ভব। স্থূলতা বা যাদের ওজন বেশি-বিশেষ করে যদি তাদের পেটের চর্বি বেশি থাকে-তাদের ইনসুলিন অকার্যকর বা প্রতিরোধ (Insulin Resistance) হওয়ার আশংকা বেশি থাকে, তাই টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য ইনসুলিন প্রতিরোধ একটি প্রধান ঝুঁকির কারণ।

ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না, যদিও কিছু বাচ্চার ত্বকে ঘন, গাঢ়, কাল মখমল প্যাঁচ তৈরি হয় যাকে অ্যাক্যানথোসিস নিগ্রিকানস (Acanthosis Nigracans) বলা হয়, সাধারণত ঘাড়ের পেছনে বা বগলের মতো শরীরের ক্রিজ এবং ভাঁজগুলোতে।

 

 

কলমকথা / সাথী